রচনা প্রতিযোগিতা ২০১৫ ২য় স্থান – প্রিয় ভ্রমণ সঙ্গী
- List of Train
- March 8, 2022
- 0
- 905
- 1 minute read
২৬ আগস্ট, ২০১৪। রাত প্রায় ৮ টার মত। কমলাপুর রেল স্টেশনের ৭ নং প্লাটফর্মে হাঁটাহাঁটি করছি দু’বন্ধু। অপেক্ষা ‘উপবন এক্সপ্রেসের’ জন্য। হয়তো আধ ঘন্টার মধ্যেই প্লাটফর্মে চলে আসবে আমাদের প্রিয় ভ্রমণ সঙ্গী। ‘প্রিয় ভ্রমণ সঙ্গী’ বললাম এজন্য যে এ নিয়ে আজ পঞ্চম বারের মত উপবন এক্সপ্রেসে চড়তে যাচ্ছি যা অন্য কোন ট্রেনের ক্ষেত্রে ঘটেনি। আজকের রাতের ট্রেনে সিলেট যাচ্ছি। ঘুরতে। যে ক’বারই কোথাও ঘুরতে গেছি আগে দেখেছি রাতের ট্রেনে যাওয়া যায় কিনা। রাতের ট্রেনে চড়তে আমার প্রচন্ড রকম ভাল লাগে। সেই যে ছোট বেলায় এক অসুখ হল, তারপর থেকেই। খুব ছোট বেলায় একবার ট্রেনে চড়েছিলাম। রাতের ট্রেন। কু লাউড়া থেকে ঢাকা। আমি বসেছিলাম জানালার পাশেই। একটু পর ট্রেন নড়তে শুরু করল। আমার শিশু মনে রাজ্যের বিস্ময়! সে বিস্ময়কে বহুগুন বাড়িয়ে দিতেই হঠাৎ চোখে পড়ল বিশাল এক চাঁদ! কী আশ্চর্য! ট্রেনের সাথে সাথে চাঁদটাও চলছে। এভাবে চাঁদ দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি… সেই থেকে শুরু। সম্ভবত সেদিন রাতেই এক অদ্ভূত অসুখ হল আমার। ট্রেন দেখলেই চড়তে ইচ্ছে করে, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে যতক্ষণ না ট্রেনটা দৃষ্টির আড়াল হয়! দিন যেতে লাগল, বছরের পর বছর। সেদিনের সেই ছোট্ট শিশুটি স্কুল-কলেজ পেরিয়ে এখন ভার্সিটিতে। কিন্তু অসুখ আর ভাল হল না। উল্টো বেড়ে গেল! বছরে দু’একবার ট্রেনে না চড়লেই যেন নয়। প্লাটফর্মে হাঁটাহাঁটির এক পর্যায়ে প্লাটফর্মের সাউন্ড সিস্টেমে ঘোষনা আসল উপবন এক্সপ্রেস ৪ নং প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে। রুদ্ধশ্বাসে দু’জন ট্রেনের দিকে ছুটলাম! ভাবখানা এমন যে আগে উঠলে আগে সিট পাবো! ব্যাপারটা আসলে তা না। আমরা দৌড় দিয়েছি কারন দু’জনেই জানালার পাশের সিটটা চাই! আর ট্রেন ভ্রমণের সমস্ত আনন্দই যেন এই জানালার পাশের সিটটাতেই। অনন্ত আমার তাই মনে হয়। শোভন চেয়ারের ছ বগির ৪৫-৪৬ সিট দু’টো ছিল আমাদের। আর দৌড়ে জানালার পাশের সিটটা আমিই দখল করে নিয়েছিলাম। সিট দখলের যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে খুশি মনে যখন জানালার নামানো এ্যালুমিনিয়ামের শাটারটা উপরে উঠাতে গেলাম, ঠোটের কোনে
ঝুলে থাকা হাসিটুকু কর্পুরকর্পুের মত উবে গেল! উঠানোই যাচ্ছে না! একক চেষ্টায় হল না দেখে আমার বন্ধুটি ও হাত লাগালো। কিন্তু জানালার শাটার অনড়, যেন এক আজন্ম শত্রুতা আমাদের সাথে! মেজাজটাই গেল বিগড়ে। কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় দফায় আবার
নামলাম নতু ন উদ্যমে। এবার ভাগ্য সহায় হল। পারলাম খুলতে। জানালা খোলা মাত্রই এক ঝটকা বাতাস স্বাগত জানিয়ে গেল। যাক, রাজ্য এবং রাজকন্যা দু’টাই জয় করা হল। এবার অপেক্ষা পালা, কখন ৯:৫০ বাজবে? ঘড়ির কাঁটা যখন ১০ টা ছুঁই ছুঁই হুই সেল বাজিয়ে ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করল উপবন এক্সপ্রেস। সেকেন্ডের কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো এর গতি। চলন্ত ট্রেনের জানালার পাশে বসলেই কেন জানি না অন্য এক ভু বনে চলে যাই। ট্রেনের ছন্দময় শব্দ আর দুলুনিতে কিসের যেন আহবান? এ এক ব্যাখ্যাতীত অনুভূতি। পুরোটা জার্নিতে এ ব্যাখ্যাতীত অনুভূতিতে বুঁদ হয়ে থাকব জানি। ট্রেনটা যতক্ষণ ঢাকা থেকে বের না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত বাইরের দৃশ্যের প্রতি খুব একটা আগ্রহ নেই। চিরচেনা কংক্রীটের ঘর বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, মানুষে ঠাসা এক ব্যস্ত নগরী। তবে ট্রেনটা ঢাকা থেকে বের হলেই আশেপাশের দৃশ্যপট বদলে যাবে।
সেদিন ছিল শুক্লপক্ষের প্রথম চাঁদ। চাঁদ খানা উঠতে দেরী ডু বতে দেরী নেই। তাই পুরো রাতটাই ছিল অন্ধকারে মোড়ানো। অন্ধকারেরও যে একটা আলো আছে, একটা ভাষা আছে সেটা শুধুমাত্র যারা রাত জাগে তারাই জানে! অন্ধকারেও সব কিছু আবছা দেখা যায়। আর চলন্ত ট্রেনের জানলা থেকে আবছা অন্ধকারে ডুবে থাকা চারপাশের প্রকৃতি অন্যরকম লাগে, অপার্থিব মনে হয়। রাতের ট্রেন ঘুমাবার জন্য না, রাত দেখার জন্য। যে ক’বারই রাতের ট্রেনে চড়েছি, ঘুমাইনি। ঐ যে, ব্যাখ্যাতীত এক অনুভূতি, সে অনুভূতি ঘুমাতে দেয় না, চোখে শিকল পড়িয়ে দেয়। খুব সম্ভবত শায়েস্তাগঞ্জের পর থেকেই পাহাড়ী এলাকা শুরু। ট্রেনটা পাহাড়ী এলাকায় ঢুকলেই চোখ কচলে রেডি হয়ে যাই বাইরের বিমূর্ত প্রকৃতি দেখতে। দু’পাশে ছোট ছোট টিলা, কখনও চা বাগান, কখনো জংলা, কখনো কখনো ট্রেনটা টিলার একদম গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে! আকাশে ফুটে আছে অনন্ত নক্ষত্র রাজি। অবছা অন্ধকারে চারপাশের প্রকৃতিকে অন্য এক জগত বলে ভ্রম হয়। সে ঘোরলাগা রূপে জানালা থেকে চোখ ফেরানো দায়। সত্যি বলতে কি, রাতের এ পাহাড়ী সৌন্দর্যের লোভেই আমি বার বার উপবন এক্সপ্রেসকে বেছে নেই।
শ্রীমঙ্গল পেড়িয়ে ট্রেনটা যখন লাউয়াছড়া বনে এসে পড়ে তখন তো ইচ্ছে হয় চেইনটা টেনে ধরি, রেল লাইন ধরে কিছুটা হাঁটি, বনের নিশাচর বাসিন্দাদের গোপন সব কথা শুনে নেই। লাউয়াছড়ার পুরো পথটুকু ই দু’বন্ধু একসাথে জানালার কাছে জড়ো হয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। আর আমাদের মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিতেই শুরু হল ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। ট্রেনটা যখন কু লাউড়া পেরোয় তখন ভোর হতে শুরু করল। ভোরের সাথে পাল্লা দিয়ে আকাশটা আবার মেঘলা হচ্ছিল। সিট
ছেড়ে চলে গেলাম দরজায়। দরজার হাতল শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। রাতের মায়া কেটে জন্ম হচ্ছে দিনের, রাত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে যখন এ বিরল মুহূর্তটি উপভোগ করছি এমন সময় প্রচন্ড শব্দে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। তু মুল বৃষ্টি। আমি মুগ্ধ হয়ে ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছি। ভাগ্যিস বৃষ্টিটা কিছুটা তীর্যকভাবে পড়ছিল বিধায় ভিজতে পেরেছিলাম। কখনো ইচ্ছে করেই মাথাটা একটু বাড়িয়ে ধরছি সামনে। সাথে থাকা বন্ধুকে ডাকলাম কিন্তু এ পাগলামিতে
যোগ দেওয়ার কোন ইচ্ছে তার নেই। প্রায় মিনিট বিশেক বৃষ্টিতে আধ ভেজা হয়ে অবশেষে আসলাম সিটে। ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মত না। ঠিক এমনই একটা গোপন ইচ্ছে অনেক দিন থেকেই লালন করছিলাম। অবশেষে পাওয়া হল। সম্ভবত ভোর ৫:৪০ এর দিকেই ট্রেনটা সিলেট স্টেশনে প্রবেশ করে। ট্রেনের গতি ধীরে ধীরে যখন কমছিল মস্তিষ্ক তার যে অংশে
‘জার্নি বাই ট্রেন’ নামের একটা ফোল্ডার তৈরি করেছে সেখানে সব কিছুট্রান্সফার করছিল। ট্রেনটা স্থির হওয়া মাত্রই ‘ফাইল ট্রান্সফার কমপ্লিটেড’। আর অদৃশ্য একটা কন্ঠস্বর বলল, “ওয়েলকাম টুসিলেট।”
লেখক পরিচিতিঃ
মোঃ রফিকুল ইসলাম
এ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার
এক্সিম ব্যাংক লিমিটেড
লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ।