অপেক্ষা
- Rail Story
- March 8, 2022
- 0
- 921
- 1 minute read
সেজুতির সাথে আমার প্রথম দেখা জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনে।
ট্রেন ভ্রমনটা আমার বরাবরই ভাল লাগে। সেদিন যখন সিলেট যাব বলে ঠিক করলাম ট্রেন ছাড়া বিকল্প ভ্রমনের চিন্তা করিনি। সময় মতই স্টেশনে পৌছেছিলাম। কাঙ্খিত সিটে বসার কিছুসময়ের মাঝেই ট্রেন ছেড়েছিল। পাশের সিটে কে বসবে তা চিন্তা করিনি। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার পরও যখন কেউ বসলো না তখন ভাবলাম যার সিট সে হয়ত ট্রেন মিস করে ট্রেন বিমানবন্দর স্টেশনে পৌছাতেই সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। পৃথিবীর সমস্ত মানুষজন এ স্টেশনেই আজ ভিড় করেছে।ঢাকা শহরের সমস্ত মানুষ যেন আজ এ ট্রেনেই ভ্রমন করবে! হন্তদন্ত হয়ে ভারী এক ব্যাগ একেবারে আমার কোলে ছুড়ে দিয়ে ভারী চশমার এক মেয়ে বলল ধরুনতো একটু।বলেই সে সামনে চলে গেল। একটু পর আরও একটি ব্যাগ হাতে ফিরে এসে আমার ঠিক পাশের সিটেই বসল। ভদ্রতার কোন তোয়াক্কা না করেই ব্যাগ গুলো গুছিয়ে রেখে ভারী এক বই নিয়ে পড়তে বসে গেল সে। আমি কিছুটা অবাকই হলাম। এখনকার মেয়েরা শুনেছি স্বার্থপর টাইপ কিংবা অতি স্মার্ট হয়। এ কোনটা আল্লাহই জানে। আমিও ভাব ধরা শুরু করলাম। যেন পাশে কে আছে জানিইনা। ভাবলেশহীন কিছুটা সময় পার করার পর টিটিই সাহেবের আগমনে মনযোগ এবার তার দিকে।টিকেট চেক করার সময় খেয়াল করলাম তার সিটটা জানালার পাশে আর আমারটা করিডোর পাশে। এবার কিছু টা লজ্জিত হয়ে কথা বলেই ফেললাম। জানালার পাশের সিটটি তার বলে তাকে বসার অফার করলাম। সে বলল সমস্যা নেই। আপনি আরাম করে বসুন। আমার একপাশে সিট হলেই হল। অবাক হলাম। মেয়েরা সাধারণত জানালার সিটটাই চায়।এ তো দেখি উল্টো। ধন্যবাদ দিয়ে পরিচিত হতে বললাম আমি রাতু ল। প্রত্যুত্তরে সে বলল আমি সেজুতি।
কি অদ্ভুত সুন্দর নাম। জিজ্ঞেস করলাম সেজুতি নামের অর্থ কি? সে একগাল মুচকি এক হাসি দিয়ে বইয়ের মাঝেই ডুবে গেল। আমি আর কথা বাড়ালাম না।
ট্রেন ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে। পৃথিবীর আলোকবর্ষের সাথে আজ সে গতির খেলায় মেতেছে। মনে হচ্ছে আলোর গতিকেও আজ পেছনে ফেলে দিবে প্রিয় জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস।
ট্রেন ছুটতে ছুটতে এখন শায়েস্তাগঞ্জ। হঠাৎ পাশ ফিরে দেখলাম সেজুতি ঘুমুচ্ছে। ট্রেনের গতিকে উপভোগ করতে করতে ওর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।নিজের প্রতি কিছুটা রাগ হল। এমন সুন্দর একটা মেয়ে পাশে বসে আছে আর আমি কিনা আছি ট্রেনের গতি নিয়ে? কোথায় মেয়েটার সাথে একটু ভাব জমাবো তা না উল্টো নিজেই ভাব নিয়ে বসে আছি। ভাবলাম সেজুতি ঘুম থেকে উঠলে এবার ভাল করে কথা বলব। কোথায় থাকে, কি করে, কোথায় যাচ্ছে এসব আর কি। আর সবকিছুতে সে যদি সাড়া দেয় তাহলে মোবাইল নাম্বার কিংবা ফেসবুক আইডিটা চেয়ে নেব। না এটা মনে হয় বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। পরে আবার নিজের এলাকা হলে এলাকার ভাই ব্রাদার দিয়ে উল্টো আমাকে প্যাদানি খাওয়াবে।
সেজুতি ঘুমুতে ঘুমুতে তার মাথা এবার আমার কাঁধে। অদ্ভুত এক ভাললাগা ছুয়ে গেল আমাকে। জীবনে প্রথম কোন মেয়ের স্পর্শ আমার কাঁধে। সরিয়ে দেব কিনা ভাবছি। লোকে দেখে কি বলবে? কি করব বুঝতে পারছিনা। বিবেক বলছে সরাতে, অবচেতন মন বলছে থাক কিছুক্ষণ। যে ভাললাগা কাজ করছে তাতে লোকে কি বলবে সে চিন্তা করে লাভ কি?
মোটা ফ্রেমের আড়ালে সেজুতির অদ্ভুত সুন্দর চোখগুলো ঢাকা পড়েছে। কি হয় চশমা না পড়লে? চশমার উপরে চুলগুল
বাতাসে খেলা করছে। মৃদু ঘামও একটু রয়েছে কপালে।খুব ইচ্ছেকরছে চোখের উপর থেকে আলতো করে চুলগুলো সরিয়ে দিতে। কিন্তু সাহস হচ্ছেনা। তাতে যদি সেজুতির ঘুম ভেঙে যায়? থাক এভাবেই থাক। এমন অদ্ভুত ভাললাগা আমার জীবনে আসেনি। আর কখনো আসবে কিনা তাও জানিনা। আচ্ছা এই মেয়েটি যদি সারাজীবন আমার পাশে আমার কাঁধে মাথা রেখে এভাবে পথ চলত খুব কি খারাপ হত? অনন্তকাল এই পথ চলাতেও আমার ক্লান্তি আসত না।
হঠাৎ ট্রেন একেবারে কষে ব্রেক করে থেমে গেল। হঠাৎ ঝাকুনিতে সেজুতির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে নিজের অবস্থা দেখে লজ্জায় লাল হয়ে সরি বলে বলল গতকাল সারারাত পড়েছে তাই একটুও ঘুমায়নি। আমি বললাম সমস্যা নেই। চাইলে আপনি এভাবে আরেকটু ঘুমাতে পারেন। সে জানালা দিয়ে বাইরে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল না না আমি সামনের স্টেশনে নেমে পড়ব। ভাইয়া হয়ত দাঁড়িয়ে আছে। কি হয় আজ ট্রেন থেকে না নামলে? কিছু বললেন? সেজুতির কথায় আবার তার দিকে তাকিয়ে বলি না না কিছু না।
সন্ধার শেষ আলোয় ট্রেন থেমেছে শ্রীমঙ্গল স্টেশনে। সেজুতি ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়িয়েছে। এখানেই নেমে পড়বে সেজুতি? আমি কি কিছু বলব? নাকি ওই কিছু বলবে? পৃথিবীর সমস্ত শক্তি দিয়েও আমি কিছু বলতে পারলাম না। সেজুতিও নেমে যাচ্ছে কিছুই না বলে। অবাক হলাম।
হঠাৎ জানালায় সেজুতি দাঁড়িয়ে। আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে বলল পুরুষ মানুষ আরেকটুসাহসী হওয়া ভাল। আর সেজুতি নামের অর্থ- “সন্ধায় দেবতাদের উদ্দ্যেশ্যে যে প্রদীপ জ্বালানো হয় তাকেই সেজুতি বলে”
কোন এক সন্ধায় যদি কোথাও প্রদীপ জ্বালানো দেখে আমাকে মনে পড়ে কিংবা গভীর কোন রাতে জোছনাকে সঙ্গী করেও খুব যদি একা লাগে তাহলে দূরের ওইযে আলোয় শেষ বাড়িটা দেখছেন সেখানে আসবেন। ওটা আমাদের বাড়ী। আমি অপেক্ষায় থাকব……..
চলবে…..
লেখক পরিচিতিঃ
আমিন ফরাজী
টিটিই, বাংলাদেশ রেলওয়