লোকোমাস্টার

 লোকোমাস্টার

“লাইন ক্লীয়ার পেয়েছি, গার্ডসিগন্যাল ওকে, স্টার্ট করুন।” সহকারি লোকোমাষ্টার সিগন্যাল বিনিময় করলেন। হুইসেল দিয়ে পাওয়ার থ্রটল এক নচ খুলতেই ট্রেন চলা শুরু করলো। প্লাটফর্মথেকে ট্রেনটি বাহির হয়ে যাবে, এমন সময় সহকারি বলেউঠলেন, “ফ্যামিলি সহ যাত্রী দৌঁড়াচ্ছে, কি করবেন?” আমি দেখার চেষ্টা করলাম, একজন ভদ্রলোক তার স্ত্রী, ছোট দুটি ছেলেমেয়ে, লাগেজ নিয়ে দৌঁড়াচ্ছেন আর ট্রেনকে থামানোর জন্য হাত তু লছেন। ছেলে মেয়ে দুটোও হাত নেড়ে ইশারা করছে। ট্রেন চলতে শুরু করলে বিনা কারণে থামানো হয় না। ট্রেনতো আর বাস ট্রাকের মত না, ব্রেকে চাপ দিলেই দশ গজের মধ্যে থেমে
যাবে। ট্রেন স্টার্ট করার যেমন কিছুসিস্টেম আছে, থামানোরও কিছুজটিল সিস্টেম আছে! ছোট নাদুসনুদুস বাচ্চাদের দেখে মনটা গলে গেলো, তাই ট্রেনকে থামিয়ে দিলাম। সোনাইমুড়ী স্টেশনে ঢাকা গামী উপকূ ল এক্সপ্রেস ট্রেনের আজকের ঘটনা এটি। পরিচর্যক নির্ধারিত আসনে বসিয়ে দিয়ে বলল,” স্যার ট্রেন থেকে নামার পর লোকোমাষ্টার সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে যাইয়েন।
“ভদ্রলোকটি একটু আয়েশ করে বসে বলল,” কাকে ধন্যবাদ দিবো? কে লোকোমাষ্টার?”

– কেন স্যার জানেন না? যারা ট্রেন চালায় তাদেরকে লোকোমাষ্টার বলে। তাদের সহানুভূতির কারণেই আপনারা ট্রেনে উঠতে পারলেন।
– কি বলো? এমন নামতো কখনও শুনি নাই!

ট্রেন চলছে, বাহিরের বিস্তীর্নসরিষা ক্ষেত, মনে হচ্ছে বাংলার বুকে জল রঙে আঁকা কোন হলুদ পরী সারা মাঠে নেচে-গেয়ে বেড়াচ্ছে। কখনও সবুজ গাছপালা হলুদের সমারোহকে ম্রিয়মান করে দিচ্ছে। ভদ্রলোকটি বাইরের প্রকৃতি থেকে চেতনা ফিরিয়ে এনে ভাবতে লাগলো, আজ যদি ড্রাইভার সাহেব ট্রেন না থামাতো আমার বড় ক্ষতি হয়ে যেত। আজ বিকাল চারটা ত্রিশ মিনিটে
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অনুষ্ঠানে আমার অংশ গ্রহণ করার কথা। বিচারকের দায়িত্বে থাকবো। আচ্ছা, ট্রেনের ড্রাইভারকে লোকোমাষ্টার বলে কেন? এত সুন্দর একটা নাম, অথচ আমরা জানি না। লোকোমাষ্টারদের জীবন
কাহিনী নিয়ে স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানালে কেমন হয়? আমার জানা মতে , বাংলাদেশে এই পেশা নিয়ে কোন চলচ্চিত্র কিংবা কোন
লেখা লেখি আগে কেউ করে নাই। ধরুন, একটা আইডিয়া পাওয়া গেলো। ঢাকা পৌঁ
ছালে লোকোমাষ্টারের সাথে পরিচয় হওয়া যাবে। অন্য ট্রেনের সাথে ক্রসিং এর কারণে আজ ট্রেন অনেকটা বিলম্ব হয়ে গেছে । বারোটা ত্রিশ মিনিটে ঢাকা স্টেশনে ট্রেন থামাই। আমি ইঞ্জিন ক্যাবরুমে বসে যাত্রীদের চলে যাওয়া দেখি। মনে হয় নিরুপদ্রব আনন্দ মিছিল যাচ্ছে। এই ট্রেনে নোয়াখালীর যাত্রী বেশি থাকে। গ্রাম থেকে ফেরার পথে অনেকেই দু’একটা হাঁস – মুরগি নিয়ে ফিরে, কারো কাছে শীতের সবজিও দেখা যায়। কেউ কেউ কলসি ভর্তি খেঁজুরের রস কিংবা দেশি মাছ ভর্তি ককশীটের প্যাকেট মাথায় নিয়ে ছুটছে। দেখে মুগ্ধ হই। কেউ আড় চোখে আমার দিকে একবার তাকিয়ে হাই, হ্যালো বলে যায়। মনে মনে, সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই। শত শত যাত্রীকে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া আমার উপর এই মহান দায়িত্ব অর্পণ করে দিয়েছেন। এমন সময় এক ভদ্রলোক লোকোমোটিভ(ইন্জিন) এর পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমার সাথে পরিচিত হতে চাইলেন।
– আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি আমার অনেক বড় উপকার করেছেন। ট্রেন থামিয়ে আমাকে না আনলে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে
যেত। আমি তার দিকে তাকিয়ে চিনতে না পারলেও নাদুসনুদুস ছেলেমেয়েদের দেখে মনে পড়ে গেলো। – না না। ধন্যবাদ দেওয়ার কিছুনেই। আমার কাজ মানুষের সেবা করা, ঠিক সেটাই করেছি।
– আমার নাম জাফর আহমদ। আমি চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করি, লেখালেখিও করি। এই নিন আমার ভিজিটিং কার্ড। একদিন সময় করে আমার বাসায় আসুন। আপনার সাথে আড্ডা দেওয়া যাবে। তাছাড়া নতু ন কোন সাবজেক্ট নিয়ে আমার আগ্রহ বেশি। আপনার পেশাটা আমাকে কৌতু হলী করেছে, আমার জানার আগ্রহ আছে। প্লিজ আসুন না একদিন! আপনার মোবাইল নাম্বারটা পেতে পারি কি?
– হ্যাঁ। শিউর….

ভদ্রলোকটির বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। দেখতে অনেকটা প্রখ্যাত সাহিত্যিক জাফর ইকবাল স্যারের মতই। নামেও অনেকটা
মিল আছে। নাদুসনুদুস বাচ্চাদের দেখে মনে হচ্ছে লেট ম্যারেজ। প্রতিষ্ঠিত লোকেরা মনে হয় বিয়েশাদী দেরিতেই করেন। উনার দেওয়া ভিজিটিং কার্ডটি ওয়ালেটে রেখে দেই। দুই মাস পর—-
প্রতিদিনের মত আজও এক জেলা থেকে আরেক জেলা, এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে ট্রেন নিয়ে ছুটে চলছি। হাজারহাজার মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছি। শত শত মানুষের অনুরোধ রক্ষা করছি। এমন সময়, একটি অপরিচিত নাম্বার হতে কল আসে। 

– হ্যালো, আসসালামু আলাইকু ম। কে বলছেন?
– ওয়ালাইকু ম সালাম। আমি জাফর আহমদ বলছি।
– কোন জাফর আহমদ? চিনতে পারলাম নাতো। দয়া করে আপনার পরিচয়টা ডিটেইলস দিবেন?
– ও; হ্যাঁ! কিছুদিন আগে সোনাইমুড়ী স্টেশনে ট্রেন মিস করতে বসেছিলাম। আপনি ট্রেন থামিয়ে তুলে নিলেন। মনে আছে?
– ও হ্যাঁ, স্যার মনে পড়ছে।
– আপনি কি দু’ একদিনের মধ্যে আমাকে সময় দিতে পারবেন।
– কোথায় যেতে হবে?
– আপনি আমার বাসায় চলে আসুন।
– ওকে! আগামীকাল বিকাল পাঁচটায় আপনার বাসায় চলে আসবো, স্যার।
– ঠিক আছে তাহলে। কাল দেখা হচ্ছে।
– জি স্যার, ভালো থাকবেন।।

ঠিকানা পেতে খুব একটা কষ্ট হয় নাই। ফেমাস লোকদের বাসা এলাকার কাক পক্ষীও চেনে। উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের বাসাটি
সহজেই খুঁজে পেলাম। কলিং বেল চাপতেই ষাটোর্ধ এক ব্যক্তি দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলেন, “কাকে চাই?”
– জি, এটা কি জাফর আহমদ স্যারের বাসা।
-হ্যাঁ, আসুন। সাহেব আপনার কথাই কইছে। আপনি (ড্রইং রুম দেখিয়ে) এইখানে বহেন, সাহেবকে খবর দেই। আমি সোফার একপাশে গিয়ে বসলাম। ওয়াল ক্যাবিনেটের দিকে চোখ যেতেই চোখ কপালে উঠলো। কয়েক হাজার বইয়ের এক সুবিশাল
লাইব্রেরি। দেওয়ালে জীবন্ত আলোকচিত্র। মুগ্ধতায় প্রাণটা ভরে উঠলো। চারদিক ঘুরে দেখতে থাকি।
কিছুক্ষণের মধ্যে ঐ বয়স্ক লোকটি হরেক রকমের নাস্তা সাজিয়ে আমার সামনে রাখলেন। মিনিট দশেক পর তিনি এসে বললেন,
“ কি ব্যাপার নাস্তায় হাত দেন নাই কেন? খাওয়া শুরু করুন।
-এই তো নিচ্ছি। আমি কোনটা আগে নিবো চিন্তায় পড়ে গেলাম। এত নাস্তার মধ্যে কোনটা আগে খাবো কনফিউজড হওয়াটাই
স্বাভাবিক।
-কি এত চিন্তা করছেন, নিন। বলে তিনি চিকেন কাবাবের বাটিটি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
আশ্চর্য্য, তিনি কিভাবে বুঝলেন চিকেন কাবাব আমার পছন্দের? আমি একটি নিয়ে খেতে শুরু করলাম।
-আচ্ছা আপনার নামটাই তো জানা হলো না। আপনিতো ট্রেন চালক মানে লোকোমাষ্টার?
-আমি ফয়সাল মাহমুদ। হ্যাঁ, আমি ট্রেন চালাই। এই সূত্র ধরেই আপনার সাথে আমার পরিচয়। আমাকে এখানে কেন ডেকে
এনেছেন?
-আমরা যাত্রী হয়ে ট্রেন চেপে বসে পড়ি। কখনো আপনাদের কথা ভাবি না। আপনাদের সুন্দর একটা নাম আছে “লোকোমাষ্টার”
এটাও আগে জানতাম না। আপনাদের পেশা নিয়ে আমি একটি স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি করতে চাই। এ ব্যাপারে আপনি কি
আমাকে সহযোগিতা করবেন? আপনি কি আমাকে কিছুধারণা দিতে পারবেন?
কথার মাঝে মাঝে আমি টুকটাক নাস্তায় কামড় বসাচ্ছি। চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,” বলুন কি জানতে চান?”
-আমার সাথে চলুন।
তিনি আমাকে ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে দো’তলার বারান্দায় নিয়ে বসালেন। তার বাড়িটি ডুপ্লেক্স। বারান্দা থেকে নয়নাভিরাম বাগান

দেখে আমি আত্মহারা। এক পাশে বকু ল গাছে ফু ল সৌরভ ছড়াচ্ছে। নাম না জানা পাখি কিচিরমিচির ডাকছে। বারান্দায় দেশি-বিদেশি নানা ফুলে বাহারি টবে ভরপুর। কতদিন বকু ল ফু ল দেখি নাই! চোখ বন্ধ করলেই মনে হয়, স্বপ্ন পুরীতে
বসে আছি।
-লোকোমাষ্টার হতে গেলে শিক্ষাগত যোগ্যতা কি লাগে? চাকরিতে কিভাবে যোগদান করতে হয়?
এমন প্রশ্ন শুনে আমি একটু অবাক হই! মনে হচ্ছে তিনি সিনেমা না বানিয়ে লোকোমাষ্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। আমি কি তাকে
জিজ্ঞেস করবো, সিনেমা বানানোর সাথে লোকোমাষ্টার হতে গেলে পড়ালেখার সম্পর্ক কি? না থাক। দেখি তিনি কি খজুঁে পান।
স্যার, সরাসরি লোকোমাষ্টার পদে নিয়োগ হয় না। সহকারি লোকোমাষ্টার পদে নিয়োগ হয়। সহকারি লোকোমাষ্টার হতে গেলে
এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাশ করতে হয়। যেমনটি বিমানের পাইলট, জাহাজের ক্যাপ্টেন, বিভিন্ন ডিফেন্সে ক্যাডেট অফিসার হতে লাগে। বয়স ১৮-৩০ বছর হতে হবে। জাতীয় পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কার্ড পাওয়ার পর প্রথমে লিখিত পরীক্ষা, পরবর্তীতে মৌখিক পরীক্ষার পর মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ সম্পন্ন হয়। পুলিশ ভেরিফিকেশনের সন্তোষজনক
রিপোর্ট প্রাপ্তির পর রেলওয়ের নিজস্ব হাসপাতালে মেডিক্যাল চেক-আপ করানো হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষার A- One রিপোর্ট পাওয়ার
পর দু’বছরের জন্য ট্রেনিং এ যেতে হয়। প্রশিক্ষণ শেষে সহকারি লোকোমাষ্টার হিসাবে যোগদান করতে হয়। এরপর বিভিন্ন
গ্রেডে পদোন্নতির পর লোকোমাষ্টার হতে পারেন।
-চাকরিটা আপনার কেমন লাগে?
-আমার কাছে খুব ভালো লাগে। চ্যালেঞ্জিং চাকরি। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরা যায়। রথ দেখা আর কলা বেঁচা এই আর কি। তাছাড়া
হ্যান্ডসাম স্যালারীও আছে।
-আপনার পরিবারে কে কে আছেন?
-আমার মা-বাবা, দুই মেয়ে, আর হোম মিনিস্টার।
-বেশ ভালো। পরিবারকে সময় দিতে পারেন?
-এক দিন পরপর। মানে একদিন বাসায় একদিন আউট স্টেশন।
-এ নিয়ে পরিবারের মধ্যে কোন অভিযোগ, অশান্তি, ঝগড়াঝাটি হয়?
-ঝগড়াঝাটি করার সময় কই। আমাদের ভালোবাসা, মায়ামমতা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আমি দু’এক দিন পরপর বাসায় ফিরি ওরা
আমার জন্য অপেক্ষায় থাকে। নিত্যনতু ন রান্না করে রাখে। মনে করে আমি মেহমান। আমাদের প্রেমের বিয়ে। চাকরিটা হওয়ার
পর ওদের পরিবার প্রথমে রাজি ছিলো না। খোঁজ নিয়ে জানেন, চাকরির ভবিষ্যৎ ভালো তাই অমত করেন নাই।
-ডিউটি সম্পর্কে কিছু বলুন?
-মহৎ কাজ করতে গেলে কষ্ট, ত্যাগ স্বীকার করে নিতে হয়। ধরুন, আমি কমলাপুর স্টেশন হতে সিলেটগামী পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেনে ডিউটিকরবো। ট্রেন ছাড়ার সময় সকাল ৬:২০। আমার ডিউটি শুরু হয় সকাল ৪:৩৫ হতে। এই বাড়তি সময় টুকুতে আমার অফিসিয়াল ফর্মালিটি এবং লোকোমোটিভ(ইঞ্জিন) চেক করে বুঝে নিতে হয়। ট্রেন চালাতে হয় শতভাগ আইন মেনে। “জি এন্ড
এস রুলস” নামক বইয়ে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ আছে। ১৮৯০ সালে বৃটিশ-ভারতের তৈরি করা আইনে রেলওয়ে পরিচালিত হয়। অবশ্য দেশ বিভাজনের পর কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আমাদেরকে অফিসিয়াল ইউনিফর্ম পরিধান করে ডিউটি করতে হয়। একটি ট্রেন শুধু লোকোমাষ্টার একাই চালান না। রেলওয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণডিপার্টমে ন্ট সরাসরি সম্পৃক্ত। রেলওেয়ের কন্ট্রোলরুম গুলো ট্রেনের প্রাণকেন্দ্র। স্টেশন মাষ্টার কন্ট্রোলের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে ট্রেনের সিগন্যাল দেন। প্রতিটি ট্রেনের শেষ প্রান্তে থাকে ট্রেনের গার্ড। ট্রেন ছাড়ার পূর্বেতিনি বাঁশি বাজিয়ে সবুজ পতাকা নাড়েন। – ট্রেন চালানোর সময় আপনার কোন অভিজ্ঞতা কিংবা দূর্ঘটনা ঘটেছিলো, যা আপনাকে কষ্ট দেয়?
– দীর্ঘ পথ চলায় অনেক দূর্ঘটনা আমার ভিতরে মোচড়াতে থাকে। সব থেকে কষ্ট পাই ট্রেনের নিচে কেউ কাটা পড়লে। রেলওয়ের ভাষায় এটাকে রান ওভার বলে। রেললাইনে হেঁটে হেঁটে মোবাইলে কথা বলা, হেডফোনে গান শোনা, অসতর্কতা এবং আত্মহত্যা দূর্ঘটনার মূল কারণ। কয়েক ডজন ঘটনার মধ্যে দুটি ঘটনা আমাকে এখনো কাঁদায়। একদিন মহানগর প্রভাতী নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছি। গুণবতী স্টেশনের অদূরে দেখতে পাই, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রেললাইনের
মধ্যে খেলা করছে। আমি হুইসেল বাজাতে থাকি। একজন শিশু বাদে বাকি সব সরে যায়। শিশুটি মনে হয় সবে মাত্র হাঁটতে শিখেছে। সে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। আশপাশে বড় কোন মানুষ নাই যে তাকে সরিয়ে নিয়ে যাবে। আমি
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। সৃষ্টি কর্তার নাম নিতে নিতে ব্রেক করার সর্বাত্তক চেষ্টা করি। আমার গায়ের লোমকূ প দাঁড়িয়ে যায়। ট্রেন ক্রমশ এগিয়ে চলছে, থামছে না। ততক্ষণে শিশুটি ট্রেনের কাছাকাছি। সে রেললাইনে এক হাত রেখে হাঁটুতে ভর করে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে কান্না করছে। পাশে থাকা ছেলেমেয়ে গুলো ওকে সরে যাওয়ার জন্য ডাকছে। আমি মহান সৃষ্টি কর্তার নাম নিতে নিতে ব্রেক রিলিজ করে পূনরায় এ্যাপ্লাই করি। ততক্ষণে আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। চোখ খুলে দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে
গেছে, কিন্তু ততক্ষণে শিশুটি লোকোমোটিভের নিচে চলে যায়। আমি লাফ দিয়ে নেমে লোকোমোটিভের নিচ থেকে শিশুটিকে বাহির করে নিয়ে আসি। উপরওয়ালাকে ধন্যবাদ জানাই, রান ওভার না হয়ে শুধুমাত্র একহাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন হয় এবং কপালে
আঘাত পায়। অন্য একদিন সূবর্ণ এক্সপ্রেস নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ফিরছি। স্পীড রেস্ট্রিকশনের কারণে কুমিল্লা স্টেশনের দিকে হুইসেল
দিতে দিতে অগ্রসর হচ্ছি। হঠাৎ একজন মহিলা ঘুমন্ত বাচ্চা কোলে নিয়ে রেললাইনের পাশ থেকে এসে রেললাইনে দাঁড়িয়ে যায়।
আমি নিস্তব্ধতা অনুভব করি। রক্ত হিমশীতল হয়ে যায়। মৃত্যুর মিছিল কাছ থেকে থেকে দেখি। পরে জানতে পারি, ট্রেনের স্পীড
কম থাকায় মহিলাটি ধাক্কা খেয়ে পাশে পড়ে যায়। তাকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু….কোলের বাচ্চাটি
চাকার নিচে পড়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। – নিচে চলুন। ডাইনিং এ খাবার দেওয়া হয়েছে। আমি সময় দেখলাম দশটা বিশ বাজে। নিচে নেমে খাবার টেবিলে কাছে গেলাম। এতটাই পরিবেশন করা হয়েছে টেবিল আর
দেখা যাচ্ছে না। খাবারগুলো আস্ত টেবিলটাকেই গিলে খেয়ে নিচ্ছে। খেতে খেতে বাকি গল্পগুলো চলতে থাক

লেখক পরিচিতিঃ

আব্দুল আওয়াল রানা
এল এম (গ্রেড-১)
পাহারতলী লোকোশেড
বাংলাদেশ রেলওয়

BRFG BRFG

Related post

Leave a Reply