রচনা প্রতিযোগিতা ২০১৫ ১ম স্থান – মায়া

 রচনা প্রতিযোগিতা ২০১৫ ১ম স্থান – মায়া

জ্যোছনা রাত । আকাশে ভরা পূর্ণিমা চাঁদ । প্রকৃতি যেন ভেসে যাচ্ছে এক অপরূপ আলোকচ্ছটার বন্যা’য় ।
তারই মাঝে হেঁটে চলেছি রেললাইন এর ধার ঘেঁষে । যতদূর চোখ যায়, কোন জনমানব এর চিহ্ন নেই । এতো রাতে কে-ই বা জেগে থাকবে !!! কিন্তু আমি জাগ্রত । ঘুম তো হারিয়ে গেছে সেই কবেই । নির্ঘুম রাত তাই এভাবেই কাটাই রেললাইন ধরে হেঁটে আর আকাশের তারা গুণে । এমন নির্জন পরিবেশে যে কারোরই ভয় পাওয়ার কথা, অশরীরি সব ভয় !!!কিন্তু আজ তো আমি সব ভয়-ডর এর ঊর্ধ্বে ।
তাই তো সকল হিসাব চুকিয়ে দিতেই ভয় কে জয় করেই সেদিনোহেঁটেছিলাম এই পথেই, জীবন পথের বাঁক হতে মুক্তি পেতে !!! সেদিন অবশ্য আজকের মতো জ্যোছনা ছিলো না । ছিলো ঘোর অমানিশার অমাবস্যা রাত । ঠিক আমার জীবনের মতো আঁধারে
ভরা সেই রাত । কি আশ্চর্য্য মিল !!!
বহু দূর হতে ছুটে আসছিলো এক যন্ত্রদানব, রেলগাড়ি । কান্নার আওয়াজ এর মতো লাগছিলো যার হর্ণ । কি এক অসীম সাহসে দাঁড়িয়ে পড়লাম মুখোমুখি ।
কত দূরত্ব হবে? জীবন আর মৃত্যু-র মাঝে যত দূরত্ব । এইটুকু দূরত্বই তখন যেন হাজার বছরের সমান ।
মৃত্যু কে তো ভয় পাইনি । তবে কেন শেষ মুহূর্তেনিজেকে ফিরিয়ে নিলাম তার দ্বারপ্রান্ত হতে??? কেনই বা পেছনে ফিরে ট্রেন এর আলোয় উদ্ভাসিত নিজেরি ছায়ামূর্তি দেখে নতু ন করে বাঁচার সাধ জন্মালো সে এক রহস্য । সেদিন থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছি, নিজের ছায়া কে সঙ্গী করেই বাঁচবো, যতদিন এই জগতে থাকবো । একমাত্র সেই নির্ভরযোগ্য, যে শত বিপদেও ছেড়ে যায় না । আর সব সম্পর্কতো শুধুই স্বার্থবাদী !!! তাই আজো রেললাইন ধরে এভাবেই হাঁটি, গল্প করি নিজের সাথে, নিজের ছায়া-র সাথে । নিজেকে মনে হয় যেন কোন দূর গন্তব্যে ছুটে চলা এক মালবাহী ট্রেন, যে শুধু ছুটেই চলে ভার বয়ে, কিন্তু সেখানে কোন কোলাহল নেই, ব্যস্ততা নেই, নেই কোন হাসি-আনন্দ । নিরন্তর ছুটে চলা আর মাঝে মাঝে থমকে যাওয়া, তারপর আবারো ছুটে চলা ।
অথচ এক সময় এই জীবনে সবি ছিলো । ছিলো হাসি-কান্না, মান-অভিমান, প্রেম-ভালোবাসা সহ সবি ছিলো । ছিলো ব্যস্ততা, ছিলো কোলাহল- ঠিক যেন এক যাত্রীবাহী ট্রেন, যার মাঝে শত মানুষের শত কথকতা গুঞ্জরিত হয়ে ছড়িয়ে যায় সবার মাঝে । তেমনি এক বৃষ্টিস্নাত মুখরিত দিনে ডাউন মহানগর প্রভাতী এক্সপ্রেস এ তার সাথে পরিচয় । কি নাম ছিলো তার? ভুলিনি, তবে ভুলে যেতে চাই বলে সে নাম আর মুখে নিই না ।
খুব মায়াময়ী ছিলো বটে । “মায়া” বলে ডাকলেও অত্যুক্তি হয় না । তাই মূল নামের পাশাপাশি এই নামেও ডাকতাম তাকে । কিন্তু আজ মায়া-র বাঁধন ছিন্ন !!! পাশাপাশি সিট বলেই গল্প জমতে সময় লাগেনি ।
স্বল্প পরিচয়েই কেউ এত্ত গল্প করে !!! তার কথার মোহে নিজেই যেন খেই হারিয়ে ফেলছিলাম । কি বাঁচাল রে বাবা !!! চট্টগ্রাম এর স্থানীয় মেয়ে । পাঁচলাইশ এ বাড়ি । বাবা-মা এর বড় আদর এর মেয়ে । কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে পরিবার ছেড়ে দূরেই থাকতে হয় তাকে । ছুটি পেয়ে বহুদিন পর বাড়ি যাচ্ছে । এগুলো আলাপ হচ্ছিলো তার সাথে সেদিন প্রথম পরিচয়ে।

ট্রেন চলতে চলতে কখন যে ভৈরব, আখাউড়া, কুমিল্লা, লাকসাম, ফেণী পেরিয়ে চট্টগ্রাম এসে পৌঁ ছালাম তা বুঝতেও পারলাম না

পুরোটা পথ তার কথার যাদুতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বশীভূত হয়ে !!!
মনের মাঝে শুধু বাজছিলো- “এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো…!!!”
শুরুটা কি এভাবেই হয়?
সেদিনই কি মনের গহীনে নতু ন কোন স্বপ্ন উঁকি মেরেছিলো?
হয়তোবা… একতরফা? নাকি দ্বিপক্ষীয়? এর জবাব তো সেই রাতেই তার প্রথম ফোনকল-
: ঠিকমতো চুয়েট এ পৌঁছাতে পেরেছেন তো?
: হ্যাঁ, ঠিকমতোই পৌঁছেছি । কোন সমস্যা হয়নি ।
: এখানে থাকবেন কয়দিন?
: এই তো, ১ সপ্তাহের মতো । কেন বলুন তো?
: না মানে যদি আপনার সময় হয় তবে একদিন বিকেলে কি একসাথে কোথাও চা-কফি খেতে পারি?
: কেন নয় ! আমি তো ফ্রি-ই আছি । এখানে বেড়াতে এসেছি । হাতে অন্য কোন কাজ তো নেই । তো কবে দেখা হচ্ছে?
: কাল বিকেলেই হোক । কি বলেন?
: ওকে, কাল বিকেলেই ।

সম্পূর্ণ ঘোরলাগা কিছুকথা । কি শুনেছি আর কি বলেছি তা বুঝতেই পরবর্তীতে অনেক সময় লেগেছে । স্বপ্ন দেখছি না তো !!!
সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা একটি মেয়ে কে ট্রেন এ ক্ষণিকের পরিচয়েই অজান্তেই মনের জানালায় স্থান দেওয়া, আবার ঠিক পরদিনই
তার তরফ থেকে চা এর বাহানায় দেখা করার সুযোগ লাভ !!! এ যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি !!!
পরদিন দেখা হলো, অনেক কথা হলো, একে অন্যের দু:খ-বেদনার কিছু কিছুখন্ড ভাগাভাগিও হলো । এ যেন এক নতু ন দিগন্তের
দ্বার উন্মোচন । এভাবেই বন্ধুত্বে র শুরু ।
দিন কয়েক পর সুবর্ণ এক্সপ্রেস এ করে ঢাকা চলে এলেও ফোন এ কথা চলতো অবিরাম । সে মুখে না বললেও ঠিকই বুঝি তার হৃদয়ের দুর্বলতা । মাসখানেক পর সে ঢাকা’য় আসার পর আবারো একদিন দেখা হলো । না, এবার আর একদিন নয়, নিয়মিতই দেখা হতে লাগলো
। কখনো সোহরাওয়ার্দী তে, কখনো ধানমন্ডি লেক এ, কখনোবা এই শহরের কোন এক রেস্টুরেন্ট এর কোণের টেবিলে । একদিন সকল দুর্বলতা জয় করে বলেই ফেললাম মনের গহীনে গোপন করে রাখা যত কথা । লজ্জায় রক্তিম তার মুখখানি ছিলো দেখার মতো !!! কিছুই বলেনি, শুধু একটু হাসির আভা ঠোঁটের কোণে !!! রাতেই জবাব পেলাম । জীবনের শ্রেষ্ঠ সেই জবাব !!! খুশি তে ট্রেন এর হর্ণ এর মতো জোরে জোরে চিতকার করে পুরো দুনিয়া কে সেই খবর জানানোর প্রচন্ড ইচ্ছা হচ্ছিলো সেই সময়ে !!! এরপর আর পেছনে তাকানো নয় । চলতে থাকলো একটি সুন্দর ও পবিত্র প্রেমকাহিনী ।
তার জীবনের সাথে মিলে গেলো এই জীবন । প্রতিটি পদক্ষেপ এ শুধু তাকে নিয়েই ভাবনা ।
তার প্রতিটি কাজে নিজেকে সপেঁ দেওয়া । তার বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন হলে নিজে গিয়ে কমলাপুর থেকে উভয়ের জন্যই টিকেট করে নিয়ে আসা । তাকে ট্রেন এ করে
চট্টগ্রাম এ রেখে আসা । বেশিরভাগ তূর্ণা তে যাওয়া হতো । সকালে পৌঁ
ছে দিনভর তার সাথে সী-বিচ, নেভালে ঘুরে-ফিরে রাতেই ওয়ান-আপ ঢাকা মেইল এ ফিরে আসা যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গিয়েছিলো সেই সময়ে । কিছুদিন পরেই তার ক্লাস শুরু হলে আবারো ট্রেন এ করে গিয়ে তাকে নিয়ে আসতাম ।

ট্রেন জার্নি অনেক পছন্দ করতো সে । এই একটি বিষয়ে তার সাথে খুব বেশিই মিল ছিলো আগে থেকেই ।
ট্রেন ছাড়া সে আসতে চাইতোও না, পারতোও না !!! কারণ টা প্রথমে না বুঝলেও পরে এর জন্য চড়া মাশুল দিতেই হয় জীবনে !!! মাঝে মাঝেই শুনতাম, তার মাথা ব্যাথা হতো । বাস জার্নি তে ঝাঁকুনি বেশি বলে সহ্য করতে পারতো না । বাস এর মাঝেই অসুস্থ্য  হয়ে পড়তো । তাই ট্রেন-ই ছিলো ভরসা । কিন্তু বিষয় টা কখনো তেমন আমল দিইনি । এরকম তো হয়েই থাকে । কিন্তু…. কারণ ছাড়া কোন কিছুই ঘটে না পৃথিবী তে ।
দিনের পর দিন তার এই সমস্যা চলতেই থাকে, কখনো কখনো তা ছাড়িয়ে যেতো সহ্যের সীমা ।
পাগলী আমার, কিছুই বুঝতে দেয়নি আমাকে !!! ওদিকে তার পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়ে, যখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর পরামর্শেমেডিকেল চেক-আপ এর পর ধরা পড়ে তার
ব্রেন ক্যান্সার !!! আর এই রোগের তেমন সুচিকিতসা এই দেশে সম্ভব নয় বলে ডাক্তার-রাও জানিয়ে দেয় ।
কি চরম সংকটকাল !!! শেষ দিকে পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ংকর রূপ ধারণ করে । অনেকেই পরামর্শদেয় ইন্ডিয়া তে নিয়ে গিয়ে চিকিতসা করার । তার পরিবারও তাই সিদ্ধান্ত নেয় । মায়া-র মা, বাবা আর ছোট ভাই যাবে তাকে নিয়ে কলকাতা । সেখানে থেকে মাদ্রাজ । ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভিসা জটিলতায় আমি যেতে পারলাম না !!! এর চেয়ে বড় দু:খ আর কি আছে !!! শেষ যেদিন তাকে বিদায় দিই, আকাশে ছিলো কালো মেঘের ঘনঘটা । ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন এর বাতাস কি সেদিন রুদ্ধ
ছিলো? আকাশ-ও কি সেদিন আমার দু:খের সারথী হয়ে দুফোঁটা জল বিসর্জন দিয়েছিলো? মৈত্রী এক্সপ্রেস এর বাংলাদেশী সাদা রেক যেন এই দু’চোখ কে সাদা ঘোলাটে করে দিচ্ছিলো সেদিন !!! আবেগ ধরে রাখা অনেক সময়ই বড় কঠিন হয়ে যায় । মৈত্রী এক্সপ্রেস চলতে শুরু করে, সেও দূরে সরে যেতে থাকে, আমিও পিছাতে থাকি, দূরে অনেক দূরে……!!! সারা জীবনের সঞ্চিত সকল অশ্রুজল নিমিষেই বাঁধ ভেঙ্গে গড়িয়ে যায় এক অস্ফুট বেদনায় !!!
এভাবে কতক্ষণ ছিলাম জানি না ।
এক সময় আনমনেই হাঁটতে থাকি রেললাইন ধরে, তার পিছে পিছে !!!
হে ঈশ্বর, তাকে সুস্থ্য করে দাও । কেড়ে নিয়ো না তাকে আমার জীবন থেকে । -এটাই ছিলো তখন একমাত্র প্রার্থনা । জীবনের ধারাই যেন পালটে গেলো । সব কিছু ভুলে তখন শুধু এই একটাই চিন্তা, সে সুস্থ্য হবে কি !!! দিনে ১০ বার করে খবর নিলেও সাধ মিটে না, মন শান্ত হয় না ।
কিন্তু জীবনের সব স্বপ্নই কি পূরণ হয়??? কিছু স্বপ্ন চিরদিনের জন্য অপূর্ণই রয়ে যায় । ৭ দিন পরেই সেই খবর এলো, যার অপেক্ষা কেউ কখনোই করে না । কিন্তু তার আসার সময় হলে এমনিতেই এসে যায় । কেউ তাকে রুখতে পারে না ।
হিমশীতল হয়ে এলো পুরো শরীর !!!
পুরো দুনিয়া যেন অন্ধকার হয়ে এলো আমার । আর কিছুই দেখতে পাই না, কিছুই শুনতে পাই না !!! এ কি হয়ে গেলো আজ !!! এর তিন দিন পর মায়া ফিরে এলো । নিথর সেই দেহ, নিশ্চুপ সেই মুখ !!!
আমি তাকাতে পারিনি, পারিনি তাকে একটিবারের জন্যেও শেষবারের মতো ছুঁয়ে দেখতে ।

হয়তোবা প্রচন্ড রাগে-ক্ষোভে কিংবা অভিমানে !!! কোথায় চলে গেলে তুমি আজ আমায় একা ফেলে !!!
কেন আমাকেও সাথে নিলে না তোমার সাথে !!! কেন তবে বলেছিলে, হবে আমার জন্ম-জন্মান্তরের সাথী !!! এত্ত স্বার্থপর কি করে হলে তুমি !!! সব মিথ্যা, সব ছলনা । তুমি কথা রাখোনি ।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, খুব বেশিই ঘৃণা করি, ঘৃণা করি তোমার এই স্বার্থপর এর মতো একলা চলে যাওয়া কে !!! ঈশ্বর… কেন আমার এমন পরীক্ষা নিচ্ছো !!! আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচবো !!! তার সাথে প্রথম পরিচয় তো ট্রেন এ । শেষ বিদায়-ও দিয়েছিলাম ট্রেন এ । কিন্তু ট্রেন এর মতো তো লম্বা হলো না এই দ্বৈতজীবন !!! আজ সে নেই, কিন্তু তার স্মৃত িগুলো এখনো খুঁজে ফিরি ট্রেন এর কেবিনে, চেয়ার এ, দরজা তে, অথবা জানালা তে উঁকি মেরে ।
আর আজো তার কথা ভেবে হেঁটে বেড়াই রেললাইন এর বাঁকে বাঁকে ।
আজ আমার জীবন-টাই একটা ট্রেন হয়ে গিয়েছে । নীরবেই ছুটে বেড়ায় এপ্রান্ত হতে ওপ্রান্তে । কত মানুষের আনাগোনা, কিন্তু তবুও নীরব লৌহনির্মিত সেই ট্রেন আর লোহা-র চেয়েও শক্ত হয়ে যাওয়া এই পাষাণ হৃদয় !!!

লেখক পরিচিতিঃ

রুশো আহমেদ
রেলফ্যান ও গ্রুপ সদস্য।

BRFG BRFG

Related post

Leave a Reply