দ্যা রানিং লিজেন্ড সিল্কসিটি এক্সপ্রেস

 দ্যা রানিং লিজেন্ড সিল্কসিটি এক্সপ্রেস

প্রতিটি ট্রেনসার্ভিসই স্বপ্নকে নিরন্তর তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। কিন্তু কিছুসার্ভিসের আগমন ঘটে সেই পথকে দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজনে। সিল্কসিটি এক্সপ্রেস তেমনই একটি ট্রেন। ‘সিল্কসিটিনামা’কে তাই ছোট করার জো কোথায়!

১৪/০৮/২০০৩ : পশ্চিমাঞ্চল থেকে ঢাকা(জয়দেবপুর)গামী প্রথম ট্রেন! বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু উদ্বোধনের দিন অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের ২৩শে জুন এতে রেললাইনসহ জামতৈল রেলস্টেশন থেকে সেতু পুর্ব রেলস্টেশন পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলসংযোগ চালুকরা হয়। এর মাধ্যমে প্রমত্তা যমুনার দুর্লংঘনীয় বাধা অতিক্রম করতে সমর্থ হয় বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল। কিন্তু একটি অপূর্ণতা রয়েই গিয়েছিল; আর তা হলো ঢাকার সাথে সরাসরি রেলসংযোগের। ২০০৩ সালের ৮ আগস্ট সেই আক্ষেপও ঘুচে যায়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এদিন রাজশাহী রেলস্টেশনে
এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজশাহী-ঢাকা(জয়দেবপুর) রুটে সরাসরি প্রথম ট্রেনসার্ভিস হিসেবে আন্তঃনগর সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। তিনি এদিন রাজশাহী রেলস্টেশন থেকে সরদহ রেলস্টেশন পর্যন্ত ভ্রমন করেন সিল্কসিটি এক্সপ্রেসে। এর মাধ্যমে সেতু পূর্বস্টেশন থেকে জয়দেবপুর স্টেশন পর্যন্ত ৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নতু ন ডুয়েলগেজ
রেললিংককে ট্রেন চলাচলের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়া হয়।

এর পরদিন থেকেই সিল্কসিটি এক্সপ্রেস তার নিয়মিত বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সূচনা করে ১২টি কোচের মাধ্যমে। ট্রেনে করে প্রথমবার রাজশাহী থেকে ঢাকা পর্যন্ত সেদিন যে ৭৭ জন যাত্রী ভ্রমন করেছিলেন তাদের একজনের ট্রিপ রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সেই আবেগকে ছোঁয়া বা বর্ণনা করার সামর্থ্য তার নিজেরও ছিলো না। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন উত্তেজিত ও আবেগাপ্লুত , তাদের চোখে মুখে ছিল স্বপ্নপূরণের তৃপ্তি। পুরো ট্রেন ছিল ফু ল দিয়ে সাজানো। এনটিভি ও বিটিভির সাংবাদিকরা তাদের ক্যামেরা- ক্রুদেরর নিয়ে ঘুরে ঘুরে ইন্টারভিউ করছিলেন যাত্রীদের। পথিমধ্যে বিভিন্ন রেলস্টেশনে শত শত উৎসুক মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল নতু ন এই ট্রেনটি দেখার জন্য। ট্রেনটি স্টেশন অতিক্রম করার সময় তারা হাত নেড়ে যাত্রীদের সম্ভাষণ জানান। যাত্রীরাও জানালায় ঝুকে হাত নেড়ে সম্ভাষনের উত্তর দিতে থাকেন অকাতরে।

সিল্কসিটি এক্সপ্রেসের প্রথমযাত্রাকে উপলক্ষ্য করে একইদিন একটি উদ্বোধনী খামসহ ১০ টাকা মূল্যমানের একটি স্মারক ডাকটিকেট অবমুক্ত করে বাংলাদেশ ডাকবিভাগ। মজার বিষয় হলো, ১৯৮৬ সালে চালু হওয়া দেশের প্রথম আন্তঃনগর ট্রেনসার্ভিস ‘মহানগর এক্সপ্রেস’-এর পর আন্তঃনগর সিল্কসিটি এক্সপ্রেসই এক্ষেত্রে একমাত্র সৌভাগ্যবান। অভাবনীয়! শিডিউল অনুযায়ী প্রথমদিন ৭৫৪ নং সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাজশাহী থেকে সকাল ৬টায় ছেড়ে জয়দেবপুর পৌছে সকাল ১১টায়। ফিরতিযাত্রায় ঐদিনই ৭৫৩ নং সিল্কসিটি এক্সপ্রেস বিকাল ৬টায় জয়দেবপুর থেকে ছেড়ে রাজশাহী পৌঁছে রাত ১১টায়। এছাড়া জয়দেবপুর থেকে কমলাপুরের যাত্রীদের আনা-নেয়ার জন্য ব্যবস্থা করা হয় কানেক্টিং শাটলের।

১৪/০৪/২০০৯ : কমলাপুরে প্রবেশ করা প্রথম ব্রডগেজ ট্রেন!
আগের বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে সিল্কসিটির মাধ্যমে ব্রডগেজ ট্রেনগুলো ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে প্রবেশ করা শুরু করে।
কিন্তু তাতে রয়ে গিয়েছিল কিছুটা অতৃপ্তি। অবস্থানগত কারণে যাত্রীদের ট্যাক্সি/বাস পেতে সমস্যা হচ্ছিলো এই স্টেশন থেকে। তাছাড়া এই স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ৩টিতে বেশী সংখ্যায় ট্রেনকে জায়গা করে দেয়াও সম্ভব হচ্ছিলো না রেলওয়ের পক্ষ থেকে। এর একমাত্র সমাধান ছিল, ঢাকার কমলাপুর টার্মিনাল পর্যন্ত ব্রডগেজ ট্রেনকে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ
মোটেও কম ছিল না। বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যস্ত ও বড় এই স্টেশনকে চালুরেখে পর্যায়ক্রমে এর পুরো ইয়ার্ডের সব পাথ এবং পয়েন্টসকে রিমডেলিং সহ প্রতিটি প্ল্যাটফর্মসংস্কার করার এই বিশাল কর্মযজ্ঞের অভিজ্ঞতা একেবারেই নতু ন ছিল বাংলাদেশ

রেলওয়ের জন্য। অবশেষে হাজির হয় সেই মাহেন্দ্রক্ষন। ২০০৯ সালের পহেলা বৈশাখে, ৫২৯ জন যাত্রী নিয়ে দুপুর দেড়টায় প্রথম ব্রডগেজ ট্রেন হিসেবে ঢাকার কমলাপুর টার্মিনালে প্রবেশ করে ৭৫৪ নং সিল্কসিটি এক্সপ্রেস, সাথে ছিল লোকো ৬৪১২। সেদিন স্টেশন প্লাটফর্মেতু মুল হর্ষধ্বনির মাধ্যমে বরণ করে নেয়া হয় ট্রেনটিকে, যাতে উপস্থিত ছিলেন ততকালীন যোগাযোগমন্ত্রী, রেলবিভাগের সচিব, বাংলাদেশ রেলওয়ের ডিজি ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মহোদয়সহ বিপুল সংখ্যক সাধারন মানুষ। একসময়ের অকল্পনীয় এই মাইলফলককে সেদিন শুধু রাজশাহীবাসীরই নয়, পুরো বাংলাদেশ রেলওয়ের ১৪৭ বছরের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

২৫/০৬/২০১৬ঃ এলএইচবি প্রযুক্তির কোচের প্রথম যাত্রা!
সময়ের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে প্রয়োজন তৈরী হয় আধুনিক যাত্রীবাহী কোচের। এছাড়া, দীঘদিনের কোচস্বল্পতা পূরণে বাংলাদেশ সরকারের দাতাবন্ধুদে র আর্থিক সহায়তায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ রেলওয়ে মোট ২৭০টি ব্রডগেজ ও মিটারগেজ যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহের প্রকল্প হাতে নেয়। এর আওতায় আমদানীকৃত এলএইচবি প্রযুক্তির আধুনিক ব্রডগেজ কোচের প্রথম চালান দিয়ে আন্তঃনগর সিল্কসিটি এক্সপ্রেসের নতু ন রেকের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ২০১৬ সালের ২৫শে জুন। অত্যন্ত উৎসবমুখর এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রেলপথ মন্ত্রী, রেলপথ মন্ত্রণয়ালয় সম্পর্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব, ভারতীয় রাষ্ট্রদূত, বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক
ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাসহ বিপুল সংখ্যক সাধারণ যাত্রীরা। আধুনিক সুবিধা ও উন্নত নিরাপত্তা ফিচার সম্বলিত এই কোচগুলোর মাধ্যমে নতু ন যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রীসেবা। বাংলাদেশের রেলভ্রমনে যাত্রীদের এমন উচ্ছসিত অভিজ্ঞতা খুব কমই আছে অতীতে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ইতিহাসে একটি ট্রেনের এতোগুলো বিশেষ মুহূর্তের সাক্ষী হবার রেকর্ডবিরল। তবে মুদ্রার উল্টোপিঠও দেখতে হয়েছে সিল্কসিটি এক্সপ্রেসকে। ২০১৩ সালের ২রা মার্চ, রাত পৌনে ১০টায় রাজশাহী রেলস্টেশনে দাঁড়ানো অবস্থায় সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনের পেছনের তিনটি কোচে আগুন দেয়া হয়। জামায়াত-শিবির কর্মীদে র এই নাশকতায় সেদিন সম্পূর্ণ পুড়ে যায় সিল্কসিটি এক্সপ্রেসের তিনটি কোচ। যাহোক, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। দেশের সম্পদগুলো সুরক্ষা করা দেশপ্রেমেরই অংশ… নাহলে কিইবা পার্থক্য রইলো দেশদ্রোহীদের সাথে আমাদের! ভালো থাকুক প্রিয় সিল্কসিটি এক্সপ্রেস! ভালো থাকুক বাংলাদেশ রেলওয়

 

লেখক পরিচিতিঃ

শাফকাত আমিন
সফটওয়্যার প্রকৌশলী
এডিএন টেকনোলজিস লিমিটেড।

BRFG BRFG

Related post

Leave a Reply