ঘাট সমাচার

 ঘাট সমাচার

বাংলাদেশে একসময় ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো খুবই নাজুক। এমন সংকটময় সময় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে চালুকরা হয় বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে ফেরী। ১৯৩৮ সালে এই রেলওয়ে ফেরী চালু হয়। এর নামকরণ করা হয় বাহাদুরাবাদ ও ফু লছড়ি রেল ফেরী ঘাট। ১৯৩৮ সালে ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে গাইবান্ধা জেলার ফু লছড়ি উপজেলায় ফু লছড়ি ও জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাটে যমুনা নদীতেরেল ফেরীর সার্ভিস চালুকরা হয়। তৎকালীন রেলওয়েকর্তৃপক্ষ ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর জেলার গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও ঠাকু রগাঁও জেলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যাত্রী ও মালামাল পারাপারের জন্য যোগাযোগ গড়ে তু লতেই এ ফেরী সার্ভিসটি চালুকরা হয়।এ সময় উত্তরবঙ্গ থেকে আগত ট্রেনগুলো দিনাজপুর, পার্বতীপুর, রংপুর,কাউনিয়া গাইবান্ধা হয়ে বোনারপাড়া আসতো। বোনারপাড়া জংশনে লোকো রিভার্স করে ফু লছড়ি ঘাটে যেত। সেখান থেকে রেল ফেরী যা কিনা কথ্য বয়ানে স্টীমার নামেই অধিক পরিচিত ছিল। স্টীমার পার হয়ে যাত্রীগন ওপাড়ে বাহাদুরাবাদ যেয়ে অপেক্ষমাণ আরেকটি সেম কম্পোজিশন রেকে জামালপুর, ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা যেত। এরপর থেকেই এ ঘাট দিয়ে স্বল্প ব্যয়ে অল্প সময়ে যাত্রী পারাপার, কৃষি পণ্য, ডিজেল, সার সরবরাহসহ নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল পরিবহন করা হতো। ১৯৮৮ সালের বন্যায় ফু লছড়ি ঘাট নদীগর্ভেবিলীন হলে প্রায় ৩ কিমি উজানে তিস্তামুখ নামে ঘাট স্থানান্তরিত হয়। ১৯৯৪ সালের পর যমুনা নদীর নাব্যতা সঙ্কটের কারণে ফেরী সার্ভিসটি তিস্তামুখ ঘাট থেকে বালাসী ঘাটে স্থানান্তর করা হয়। বালাসীতে স্থানান্তরের পরে কার্যত বোনারপাড়া তার জংশন নাম হারিয়ে ফেলে।সাথে বোনারপাড়া থেকে ভরতখালী হয়ে ফুলছড়ি অবধি রেলরুটটিও সারাজীবনের জন্য হারিয়ে যায়। এসময় বোনারপাড়ার বদলে ১২ কিমি ডাউনে ত্রিমোহনী জংশন তৈরী হয় এবং ত্রিমোহনী হতে বালাসী পর্যন্ত নতু ন লাইন বসানো হয়। আর তখন থেকে ট্রেন গুলো বোনারপাড়ার পরিবর্তে ত্রিমোহনী জংশনে লোকো রিভার্সকরে বালাসী যেতে শুরু করে। এসময় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের আগে দিনাজপুর থেকে রংপুর হয়ে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বালাসীঘাট পর্যন্ত ট্রেনে যাতায়াত করত এতদাঞ্চলের মানুষ। এছাড়াও সান্তাহার, বগুড়া, বোনারপাড়া হয়েও ট্রেনে এ ঘাট দিয়ে মানুষ চলাচল করত। তবে বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর পর থেকে যাত্রীবাহী লোকাল, মেইল ট্রেন ও আন্তঃনগর একতা, তিস্তা, করতোয়া ট্রেন ও ঐতিহ্যবাহী ৭ আপ ৮ ডাউন মেইল তথা উত্তরবঙ্গ মেইল চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে কিছুদিন মালবাহী ওয়াগন চলাচল করলেও ওয়াগন ফেরী বন্ধ থাকায় তা নিয়মিত চলাচল করে না। বছরের অধিকাংশ সময়ই ওয়াগন ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে। তবে পরিবর্তিত নৌ চ্যানেলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রেলওয়ে ফেরী ঘাটেরও স্থান পরিবর্তন শুরু হয়। উত্তরাঞ্চলের এই ঘাটটি তিস্তামুখ, ফু লছড়ি, অবশেষে বালাসী ঘাট নামে রেলওয়ে ফেরীঘাট হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৮৮ এর ঐতিহাসিক বন্যায় বালাসী ও বাহাদুরাবাদ দু’টি ঘাটেরই মূল নকশা বদলে যায়। নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে বারবার ঘাটের অবকাঠামো পরিবর্তন ও এর ব্যয়ভার রেলওয়ের বার্ষিক বাজেটের ওপরেও প্রভাব ফেলে। এর অনেক পরে ১৯৯৪ সালের দিকে যমুনা নদীর নাব্যতা কমে এলে ওপাড়ের ঘাটের নতু ন ঠিকানা হয় গাইবান্ধার বালাসীতে। যা আগেই আলোচনা করেছি। এই দুই ঘাটেই ভীড়তো বড় বড় জাহাজ, লঞ্চ, স্টিমার সহ নানা নৌযান। এই ঘাট বা নৌ বন্দরের মাধ্যমে পরিবহন চালু ছিলো দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশেও। এই রেলওয়ে ফেরী সার্ভিসটি যাত্রা শুরু করেছিলো আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের অধীনে। ফেরীর লাইনের সংখ্যা ১৩টি এবং একেকটি লাইনে ৩টি করে বগি বা ওয়াগন নেয়া যায়। ১৯৮৯ হতে ২০০৪ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে বালাসী বাহাদুরাবাদ ঘাটের মধ্যে রেলওয়ে ফেরী পারাপারে অনন্য ছিলো। এর মাধ্যমে তিস্তা ও একতা এক্সপ্রেস ট্রেন দু’টি যমুনার উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম তীরের রাজশাহী, রংপুর বিভাগের যাত্রাপথে নতু ন দিগন্ত উন্মোচন করে। এছাড়াও পূর্বতীরের সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগের একমাত্র সহজ ও স্বল্পব্যয়ী রেলওয়ের যাতায়াত রুটে পরিণত হয়। তবে যমুনা ও তিস্তা নদীর নাব্যতা এতটাই নীচে নামত যে, নদী পথে মাত্র ৪ মাস ফেরী চলাচল করা সম্ভব হয়।  স্থানীয় বড়সড় মহাজনী নৌকাগুলোও চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। এই ফেরী ঘাট দিয়ে একতা ও তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রতিদিন উত্তরাঞ্চল হতে হাজার হাজার মানুষ রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চলাচল করতো। গ্রীষ্মকালে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় চলাচলকারী স্টিমার ও ফেরীগুলো চোরাবালিতে মাঝ নদীতে আটকা পড়তে থাকে। বালাসী ঘাটে পানির নাব্যতা একেবারেই কমে যাওয়ায় ঢাকা ও দিনাজপুরগামী ট্রেনের যাত্রীরা নৌকা দিয়ে পারাপার শুরু করে। শুকনো মৌসুমে এই নৌকা পারাপার একটি বিপজ্জনক ও ঝুঁ কিপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। পরে বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেলপথ বসানোর কাজ শেষ হয় ১৪ জুলাই ২০০৫ সালে রেলওয়ে বিভাগ বালাসী বাহাদুরাবাদ রেলওয়ে ফেরী পারাপার বন্ধ করে। তার পরিবর্তে যমুনা সেতু র উপর দিয়ে রেল চলাচলের সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে উত্তারাঞ্চলের জেলা গুলোর সঙ্গে সিলেট ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তখন এই রেল পথে চলাচল করার একমাত্র গন্তব্য ছিলো বাহাদুরাবাদ ঘাট। কালক্রমে নদী ভাঙনের ফলে বাহাদুরাবাদ ঘাট আজ সেই ইউনিয়ন থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। ঐতিহাসিক সময়ের স্মৃত ি ধারন করে বাহাদুরাবাদ ঘাট ও বালাসী ঘাট রয়েছে ঠিকই। তবে অতীতের সেই জৌলুস এখন আর নেই। প্রায় ১৫ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে বাহাদুরাবাদ ও বালাসী ফেরী ঘাট। ২০০১ সালে যমুনা সেতু চালুর পর যমুনা নদীর ভাঙ্গন ও নাব্য হ্রাসের অজুহাতে গাইবান্ধার বালাসীঘাট এবং জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাটের মধ্যে রেলওয়ে ফেরী সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হয়। মাঝে মাঝে ডেড লোকো পারাপার করা হলেও ৫ এ ফেরী সার্ভিসটি বন্ধ থাকায় রাজধানী ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলের ১৩ জে’লার পণ্য সরবরাহ এবং যাত্রী পারাপারে বহু সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি বালাসী ঘাটকে কেন্দ্র করে উপার্জনশীল কুলি, শ্রমিক,
হোটেল ব্যবসায়ী, কর্মচারীসহ অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। একসময়ের জনাকীর্ণ এই ঘাট গুলো এখন বিরান ভূমি (ছবিতে দেখুন)। রূপ,যৌবন,জৌলুস হারিয়ে ঘাটগুলো আজ কালের সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে। পেছনে ফেলে এসেছে সোনালী অতীত। এই ঘাট নিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে আমার প্রচুর স্মৃতি বিদ্যমান। সেগুলোর আলোচনা আরেকদিনের জন্য তোলা থাকলো। ছবিঃবিভিন্ন সময়ে নিজের তোলা।

 

তথ্যসূত্রঃ

১. উত্তরবঙ্গের ইতিহাস। সূফী মোতাহার হোসেন।
২. রংপুর জেলার ইতিহাস। সূফী মোতাহার হোসেন।
৩. Rangpur District Gazetteers. জেলা প্রসাশন, রংপুর।
৪. বালাসী ঘাটের ইতিকথা। মোঃ শফিউল আলম।
৫. বৃহত্তর রংপুরের আদিকথন। মোঃ মাহমুদুল আলম সোয়েব। রংপুর জেলা সমতি,ঢাকার স্মরণিকায় প্রকাশিত।
৬. গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন ওয়েবসাইট।
৭. উইকিপিডিয়া।
৮. দৈনিক প্রবাসী কন্ঠ।

 

লেখক পরিচিতিঃ

মোঃ মাহমুদুল আলম সোয়েব
সিনিয়র সেলস ম্যানেজার
ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, উত্তরা, ঢাকা।

BRFG BRFG

Related post

Leave a Reply