সুবর্ণ এক্সপ্রেস – একটি অভিজাত সেবা

সুবর্ণ এক্সপ্রেস — এক গৌরবময় ঐতিহ্যের জন্মকথা
অনেকে ভালোবেসে সুবর্ণ এক্সপ্রেসকে ডাকেন “জমিদার” নামে।
হয়তো কারণ, ট্রেন কন্ট্রোল সিস্টেমে এটি বরাবরই প্রেফারেন্স পায়। হয়তো কারণ, এর যাত্রীসেবা সবসময় মনিটর করা হয়। হয়তো কারণ, দেশের সেরা ইঞ্জিন আর কোচগুলো বরাদ্দ থাকে এই ট্রেনের জন্য। হয়তো কারণ, সবচেয়ে দক্ষ এবং দায়িত্বশীল ক্রুরা এই ট্রেনে ডিউটি করাকে সম্মানের বিষয় মনে করেন। হয়তো কারণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম উভয় স্টেশনেই ট্রেনটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মে স্থান পায়। হয়তো কারণ, এটি দেশের রাজধানী ও প্রধান সমুদ্রবন্দরকে যুক্ত করে। হয়তো কারণ, এটি পুরো রুটে সর্বোচ্চ অনুমোদিত গতিতে চলে।
হ্যাঁ, এসবই সত্য।
কিন্তু এই সম্মান ও মর্যাদার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল সেইসব দূরদর্শী রেল কর্মকর্তাদের চিন্তা ও আগ্রহ থেকে—যারা একে “ফ্ল্যাগশিপ ট্রেন” হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই অনুযায়ী কাজ করেছিলেন।
১৪ই এপ্রিল ১৯৯৮ — বাংলা ১৪০৩ সালের পহেলা বৈশাখ — বাংলাদেশের রেলপথের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন।
এই দিনে যাত্রা শুরু করে সুবর্ণ এক্সপ্রেস — দেশের প্রথম নন-স্টপ আন্তঃনগর ট্রেন, যা আজও চলছে দেশের রেল ব্যবস্থার সক্ষমতার প্রতীক হয়ে।
“সুবর্ণ” নামটি এসেছিল রেলওয়ের আয়োজিত একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে — সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় চুড়ান্ত হয় একমাত্র বিরতিহীন এই ট্রেনের নামকরণ।
শুরুর দিকে ইরান থেকে আমদানিকৃত নতুন কোচ দিয়ে গঠিত হয় এই ট্রেনের রেক—১০টি শোভন চেয়ারসহ মোট ১৩টি কোচ নিয়ে গঠিত সেই মিটারগেজ রেক ছিল সে সময়কার সর্ববৃহৎ লোড সক্ষমতা সম্পন্ন রেক।
এখানেই শেষ নয়—এই ট্রেনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো রেলওয়ের যাত্রীসেবায় যুক্ত হয় ব্যক্তি খাত।
On-board service পরিচালনার জন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়— নতুনত্বটি ছিল সেখানেই। On-board service এর মধ্যে রয়েছে ট্রেনের প্রতিটি কোচ ও টয়লেট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, ধোয়া সিট কভার, তোয়ালে ও নতুন সাবান সরবরাহ করা, যাত্রীকে ট্রেনে উঠতে সাহায্য করা ও টিকেট নম্বর অনুযায়ী নির্ধারিত সিটে বসিয়ে দেয়া, public address system এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ঘোষনা ও সঙ্গীত পরিবেশন
করা, বুফে কারে/কার থেকে খাবার-পানীয় সরবরাহ করা।
এখানে কন্ট্রাকটর নির্বাচনের জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী টু-স্টেজ বিডিং পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়– যেখানে আলোচনা করে চুড়ান্ত দরপত্র তৈরি করা হয়।
বুফে কারের ব্যবসা চালানোর জন্য কন্ট্রাকটর রেলওয়েকে ভাড়া দেবে, আর অন্যান্য সার্ভিসের জন্য রেল কনট্রাকটরকে মূল্য দেবে। এ দুয়ের পার্থক্যের ভিত্তিতে নিম্নতম দরদাতা নির্ধারিত হয় এবং “ফুড হ্যাভেন” নামে প্রাইভেট কোম্পানী কাজটি পায়।
সুবর্ণ এক্সপ্রেসে টিকিটের সঙ্গে খাবারের দাম যুক্ত করার পূর্বের রীতি বাদ দেওয়া হয়। তবে আলোচনা করে কয়েকটি আইটেমের দাম আগেই স্থির করে দেয়া হয়, যেমন চা, বাটার টোস্ট, চিকেন কাটলেট, ডিম, সফট ড্রিংকস ইত্যাদি। অন্যান্য আইটেমও যাত্রীরা নিজের পছন্দমতো কিনে খেতে পারেন।
এর মাধ্যমে ট্রেন চালানো ছাড়া সবকিছুই ব্যাক্তিখাতে চলে যায়। এর আগে আন্তঃনগর ট্রেনের সিট রিজার্ভেশন ও টিকেটিং সিস্টেমে ব্যাক্তিখাতকে সম্পৃক্ত করা হয়।
চট্টগ্রাম থেকে সকালে ট্রেনটি উদ্বোধন করেন যোগাযোগ সচিব সৈয়দ রেজাউল হায়াত। সাথে ছিলেন রেলওয়ের মহাপরিচালক জনাব এম এ মুনাফ, যমুনা সেতু নির্মান প্রকল্পের রেলওয়ে অংশের প্রকল্প পরিচালক জনাব আতিকুল হোসেইন খান, পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জনাব ফরহাদ রেজা ও অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
উদ্বোধনী যাত্রায় ৬০০ যাত্রী নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত আসতে সুবর্ন এক্সপ্রেসের সময় লেগেছিল ৪ ঘন্টা, অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই ট্রেনটি ঢাকা স্টেশনে পৌঁছায়।
সুবর্ণ এক্সপ্রেস চালুর মাধ্যমে জাতির প্রতি নিজের অঙ্গীকার প্রমাণ করেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। এখন সময় হয়েছে — এটিকে আরও বড় করে তোলার।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও রাজশাহী রুটে ৫ ঘন্টার কম সময়ে যদি ট্রেনের একটি ট্রিপ দেয়া যায় তবে একটি রেক দিয়ে দিনে ৩টি ট্রিপ দেওয়া সম্ভব। এতে বিদ্যমান ইঞ্জিন ও কোচ দিয়ে দেড় গুন বেশি সংখ্যক ট্রেন চালানো যাবে– সুবর্ণ এক্সপ্রেসের সেই পুরোনো উদ্যমেই নতুন গতির সূচনা ঘটানো সম্ভব।