রচনা প্রতিযোগিতা ২০১৫ ৩য় স্থান – এ জার্নি বাই ট্রেন : এ জার্নি থ্রো নস্টালজিয়া
- SOCIAL RESPONSIBILITY
- March 8, 2022
- 0
- 876
- 1 minute read
চট্টগ্রাম অভিমূখী আন্তঃনগর মহানগর প্রভাতী আর কিছুক্ষণের মধ্যে পূর্বদিকে এক নম্বর প্লাটফর্মে আসিতেছে। যে সমস্ত যাত্রীগণ এখনো.”। আড়মোড়া ভেঙে ওয়েটিং রুমথেকে বের হলাম। বেশীক্ষন বসে থাকা লাগে নি অবশ্য। আগে ফোন দিতাম এক টিকিটব্ল্যাকারকে,টিকিট নেব এই বলে গাড়ি কোথায় জেনে নিতাম। এখন গ্রুপ আছে, একটা পোস্ট করলেই জানা যায়। তাছাড়া
এসএমএস তো আছেই। মোবাইল মানিব্যাগ নিয়ে ঢোকালাম শার্টের বোতামওয়ালা পকেটে। ট্রাভেল ব্যাগটা হাতে নিয়ে এগোতে এগোতে উত্তরদিকে তাকাই। ঐ যে আসছে। “এই বাবু, পেছনে এসে দাঁড়াও”,ছোট বাচ্চাটাকে ডাক দিয়ে বলি।ট্রেন দেখতে প্লাটফর্মের কিনারায় চলে গেছিল। বাচ্চার মা-ই দৌড়ে এসে কোলে নিয়ে নিল। একসময় আমিও এমন ছিলাম না কি? কত দৌড়ে
গেছি কুঝিক ঝিক দেখতে, আব্বুটেনে ধরেছেন, আম্মু ভয় দেখিয়েছেন কাটা পড়ার।ছোটবেলার অল্পকিছু ছবি আছে এলবামে। এর একটা খুব চোখে ভাসে। আব্বু আম্মু ট্রেনে বসা, সুলভ সীটে, পাশাপাশি।দুজনের কোলে লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছি আমি। রঙিন কেডস পরা পা দুখানা সীটের পাশে ঝু লছে। বয়স কত তখন? আড়াই কি তিন। গ্রামের বাড়ি লাকসাম। চট্টগ্রাম থেকে কোন সরাসরি বাসরুট নেই। তাই আশৈশব ট্রেনের সাথে পরিচয়, প্রেম। লাইন এগোচ্ছে, এক হাতে হ্যান্ডেল ধরে উঠে পড়লাম। আজকে শোভন চেয়ারে। মাঝখানে, মুখোমুখি সীটগুলোর একটায়। অপরিচিত সহযাত্রী। তাও উঠেই ঘুম দিয়েছেন। অন্যসময়
সাথে বন্ধুরা থাকে, গল্প আড্ডা দিয়ে সময় যায়। এরকম একটা আড্ডার অনেক বিষয় থাকে। যেমন ট্রেন জার্নি বনাম বাস জার্নি। বেশীরভাগ বন্ধু আমার একরোখা ট্রেন সাপোর্ট মানতে পারে না। “আমি টাকা দিয়া টিকিট কাটলাম, এখন আমি নাকি গাড়ির জন্য ওয়েট করমু, গাড়ি আসবো, এরপর উঠমু, তারপরও দাঁড়ায় থাকবো”,রাসেল যুক্তি দেয়। আমি হাসি। এরপর আমার যুক্তি দেই, ট্রেন নিরাপদ, আরামদায়ক, হাঁটাচলা করা যায়, টয়লেটে যাওয়া যায়, ক্লান্তি লাগে না ইত্যাদি পয়েন্টে বক্তব্য দেই, “এই যে দেখ এখন
আড্ডা দিতেছি, এইটা তো তু ই বাসে পারবিনা”। “হ, তোরে কইছে ট্রেন নিরাপদ, ক্যান ফার্স্ট ইয়ারে তোর ব্যাগ চুরি গেলোনা?”, ঝাঁজের সাথে বলে ফিরোজ। কথা সত্য। ফার্স্ট ইয়ারে ঈদের বন্ধে বাসায় যাওয়ার সময় গাড়ি ফেনী এসে থামলে খেয়াল করি মাথার উপর ব্যাগ নেই। এরপর দৌড়াদৌড়ি, প্লাটফর্মের এমাথা ওমাথা। শেষে ফেনী স্টেশনের রেলপুলিশের ফাঁড়িতে কর্মকর্তার ডায়রীতে নাম ফোন নম্বর লিখে লোকাল ট্রেনে চট্টগ্রাম ফিরি। সে ব্যাগ কখনোই মেলেনি। গাড়ি ফেনী নদীর ব্রিজ পার হচ্ছে। এই ব্রিজটার মধ্যে পাশে দাঁড়ানো যায় এরকম দুটো জায়গা আছে। একবার পাশের যাত্রী প্রথম ট্রেনে চড়েছে, ইয়াং ছেলে, তার আগ্রহ
দেখে জানালার সীট ছেড়ে দিলাম। সে মাথা বের করে দেখছে, খুব উত্তেজিত। এই ব্রিজের উপর আসতেই ছেলেটা সীটে ঝিম
মেরে বসে গেল। তাকিয়ে দেখি কান গাল লাল হয়ে আছে। ঐ দাঁড়ানোর জায়গায় কোন বখাটে ছিল, সপাটে ভদ্রলোকের গালে চড় মেরেছে। আর এখনতো ঢিল ছোঁড়ার ভয়ে শাটারই ফেলে রাখি কত জায়গায় লাইন খুলে রাখছে, একসিডেন্ট হচ্ছে। “চিপস, লাগবে চিপস, স্যার চিপস”,ক্যাটারিং এর লোক বড় পলিথিনে করে চিপস বিক্রি করছে। এদের দেখলেই আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। একবার সামনের যাত্রী তার বাচ্চাকে বয়ামের মত চিপস কিনে দিল। কি যে লোভ লেগেছিল। আব্বুকে বলব, এমন
সময় দেখি ঐ লোক বড় একটা নোটে দাম মেটাচ্ছে। আব্বুকে আর বলিনি। জানতাম বাবার বেতন বেশী না, বললে যদি বাবার খরচ করতে কষ্ট হয়! সেই থেকে বয়ামের চিপস অর্থাৎ Pringles আজো কেনা হয়নি। পছন্দের বোম্বে পটেটো চিপসই কিনলাম। খেতে খেতে এই যে ট্রেনের ভাড়া বাসের চেয়ে কম এটা যেমন ঠিক, তেমনি একটু পর পর যেভাবে চিপস, চানাচুর, ডিম, সিংগারা, ঠান্ডা কোক, শসা, নাস্তা, চা আসতে থাকে তাতে আর সাশ্রয় হয় কই?এর মধ্যে ট্রেন চিনকি পার হয়েছে। চিনকি আস্তানা,
মস্তান নগর, কি সব নাম রে বাবা ! বাচ্চাকালে একবার মামার সাথে যাচ্ছি, মামা কাজ দিলেন প্রতিটা স্টেশন পেরোলে তার নাম
লিখতে হবে। পারিনি, অর্ধেক পথ যেতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এদিক থেকে রেলপথ কত সুন্দর! একদিকে সারি সারি পাহাড় আর শস্যক্ষেত, অন্যদিকে মহাসড়ক। যেন হ্যারি পটারের হগওয়ার্টস এক্সপ্রেস চলছে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে। বাসগুলো ছু
টছে, কিছুক্ষন পাল্লা দিয়ে আবার জ্যামে পড়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। ক্ষেতের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা রাস্তা। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে। দাঁড়িয়ে পড়েছে, ট্রেন দেখছে। আচ্ছা, প্রতিদিনইতো দেখে, তবু নতু ন করে সেই পুরনো ট্রেন দেখতে হবে কেনো? নাকি মানুষগুলো নতু ন বলে? হাত নাড়লাম। প্রত্যুত্তরে ওরাও হাত নাড়ে হাসিমুখে। দুয়েকজন দৌড়নোর চেষ্টা করে। আচ্ছা, ওরা কেউ এডিথ নেসবিটের ‘দ্যারেলওয়ে চিলড্রেন’ পড়েছে? ববি, পিটার, ফিলিস কে ওরা চেনে? বাচ্চা তিনটেকে পুরো ট্রেনের মানুষ হাত নাড়ছে এই লাইনগুলো কল্পনা করলে আমার অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়। হঠাৎ একটা ঝাঁকিতে ঘুম ভেঙে গেল। কোন ফাঁকে চোখের পাতা লেগে এসছিল বুঝতে পারিনি। চোখ মেলে প্রথম নজর যায় মাথার উপরে। নাহ, ব্যাগ মহাশয় ঠিকঠাক আছেন। চোর পালিয়ে বুদ্ধি বেড়েছে আর কি! বাইরে তাকিয়ে দেখি দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের নীচে দাঁড়িয়েছে গাড়ি,
টিকিটবিহীন যাত্রীরা অনেকে নেমে যাচ্ছে। ব্যাগ নামিয়ে রেডি হলাম নামার জন্য। প্লাটফর্মেনেমে নতু ন স্টেশনের দিকে হাঁটি, ফিরতি টিকিটটা করে ফেলতে হবে। ইন্জিনটা এখনো গরগর করছে। শেডে যাবে বোধহয়। “শেড হচ্ছে ট্রেনের বাড়ি”, মামা বলেছিলেন। ঐযে শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, “ঝক ঝকা ঝক ট্রেন চলেছে ঐ, ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই?” হঠাৎ কি মনে করে মোবাইলটা বের করলাম। লোকোমটিভ এর সাথে একটা সেলফি তোলা যাক। গ্রুপে দেয়া যাবে। রেলের হাজারো সমস্যার মাঝেও যারা রেলকে ভালোবাসে এমন হাজার পনের মানুষের সাথে শেয়ার করা যায় অবশ্যি। ডাটা কানেকশনটা অন করতে করতে EXIT লেখা গেটের দিকে এগোই।
লেখক পরিচিতিঃ
শাহ ফাহিম আহমেদ ফয়সাল
আবাসিক মেডিকেল অফিসার
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, চকরিয়া,
কক্সবাজার।